বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৭

প্রশ্ন: এটা কি সত্যি যে মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্দলভী লিখিত ‘ফাযায়েলে আমাল’ বইয়ে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যাতে শির্ক নিহিত রয়েছে?

উত্তর: সর্বোচ্চ প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য।
ফাযায়েলে আমাল বইটি যেটির মুল নাম ছিল তাবলীগী নিসাব’ – সেটি মুহাম্মদ যাকারিয়া কান্দলভী লিখিত এবং এটি নানা বিষয়ক ধর্মীয় আমালের কতকগুলো অনুচ্ছেদের সংকলন। এটি লেখক তাবলীগ জামাআতীদের জন্য পঠনীয় বই হিসেবে লিখেছেন। এটা এখন তাদের জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, যা তারা তাদের মজলিসে, বিদ্যাপীঠে এবং মসজিদগুলোতে পাঠ করে থাকে। এটি উর্দুতে লেখা হয়েছে, যার কারনে আরব দেশগুলোতে এর প্রসার হয় নাই; কিন্তু এটা ঐসব দেশ যেখানে তাবলীগ জামায়াতের প্রসার ঘটেছে যেমন ভারত, পাকিস্থান ও আফগানিস্তান সেখানে সুপরিচিত।
>>শাইখ হমুদ আত-তুওয়াইজরী তাঁর কওল আল বালীগ” (পৃ:১১) বইয়ে লিখেছেন তাবলীগীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হল তাবলীগী নিসাব’ (এখন ফাযায়েলে আমালনামে পরিচিত), যেটা লিখেছেন তাদের অন্যতম নেতা মুহাম্মদ যাকারিয়া কান্দলভীতারা এই বইয়ের প্রতি খুব বেশি নজর দেয়, তারা এটাকে ঐরূপভাবে মর্যাদা দান করে যেমন আহল আস-সুন্নাহ আস-সহীহায়েন’ (বুখারী ও মুসলিম) এবং অন্যান্য হাদীসের বইকে সম্মান করে। ভারতীয় ও অন্যান্য আরবী নয় এমন তাবলীগী লোকেরা এটাকে তাদের দাওয়াতী কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য বই বানিয়ে নিয়েছেন। এই বইয়ে বহু সংখ্যক শির্ক মিশ্রিত বিষয় রয়েছে, রয়েছে বিদায়াত, বানোয়াট কাহিনী, জাল ও জয়ীফ হাদীসসমূহ। বস্তুত: এটা একটি শয়তানী, গোমরাহ ও ফিতনাহ সৃষ্টিকারী বই
>>শাইখ শামস্‌ আদ-দীন আফগানী বলেন, “দেওবন্দীদের নেতৃত্বস্থানীয় ইমামদের লিখিত অনেক বই রয়েছে যেগুলো দেওবন্দীরা ভক্তি সহকারে পড়ে, কিন্তু সেগুলোতে কবর-পুজারীদের এবং সূফী তরীকাদের বানোয়াট কাহিনীতে ভরাউদারণস্বরূপ তিনি কতকগুলো বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে তাবলীগী নিসাব, যেমন নিসাব আত-তাবলীগ, এবং মানহাজ আত-তাবলীগ। এই দেওবন্দীরা প্রকাশ্যভাবে এই বইগুলোকে অস্বীকার করে না বা এগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে না এবং তারা এগুলোর ছাপা ও বিক্রি বন্ধ করে না। ভারত, পাকিস্থান এবং অন্যান্য স্থানের মার্কেটগুলো এসব বইয়ে সয়লাব।
[
যুহুদ উলামা আল-হানাফিয়াহ ফি ইবতাল আকাঈদ আল-কবুরিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ: ৭৭৬]
>>ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দাঈমাহ (ভলিউম-২, ২/৯৭) বলা হয়েছে -
প্রশ্ন: আমি একজন মুসলিম বৃটেনে থাকি, এবং আমি আমার জীবনের সকলক্ষেত্রে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের দেখানো পথ অবলম্বন করতে চাই। যার কারনে আমি উর্দুতে ধর্মীয় বই পড়ার চেষ্টা করি। যখন আমি দেওবন্দী জামায়াতে তাবলীগের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম, যার নাম মুহাম্মদ যাকারিয়া কান্দলভী, শাইখুল হাদীস, উনার লিখিত কিছু ধর্মীয় বই পড়ছিলাম, তখন দেখতে পেলাম তাবলীগী নিসাববইয়ের ৫ নং পরিচ্ছেদের ১১৩ নং পৃষ্ঠায় একটি কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে যা লেখক রওনক আল মাজালিসবই থেকে নকল করেছেন। কাহিনীটি ছিল এক বণিককে নিয়ে যিনি মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পক্তি দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করা হয়। তার অগাধ সম্পত্তির মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর একটি চুলও ছিল। ছোট ছেলেটি রাসূল (সা:) এর চুলটি নিজের ভাগে নিলেন এবং যার কারনে বাবার সমস্ত সম্পত্তি বড় ভাইকে দিয়ে দিতে হল। পরবর্তীতে যা ঘটল তা হল কিছুদিনের মধ্যেই বড় ভাই নি:স্ব হয়ে গেলেন, আর ছোট ভাই অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে গেল। ছোট ভাই যার অধিকারে চুলটি ছিল- তার মৃত্যুর পর, একজন বুযুর্গ হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে স্বপ্নে দেখলেন, এবং নবী (সা:) তাকে বলছেন, “যেই ব্যাক্তির কোন জিনিসের প্রয়োজন দেখা দেয় সে যেন ঐ ব্যক্তির কবরের পার্শ্বে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে (যাতে আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন
আমি উক্ত লেখকেরই আরেকটি বই পড়েছি যার নাম তারীখ মাশাঈখ যুথথাতযার ২৩২ নং পৃষ্ঠায় শাইখ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজীর মাক্কীর কথা বলেছেন। শাইখ মাক্কী যখন চূড়ান্ত পীড়িত অবস্থায় ছিলেন তখন তার এক ভক্ত তাকে দেখতে এসে খুব শোকাহত হয়ে পড়ে। শাইখ যখন বুঝতে পারলেন তার শিষ্যের মনের ভারাক্রান্ত অবস্থা তখন বললেন, “শোক কর না, ফাকীর কখনও মরে না; বরং মৃত্যুর পর কবর থেকে সে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গমন করে, এবং মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে, যেমন সে জীবিত অবস্থায় পূরণ করত
আমি (বৃটেনের অধিবাসী) উপরোক্ত বিষয়ে আপনার সুচিন্তিত মতামত জানতে চাই এবং এর সাথে নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাই..
(১) এই লেখক এবং যার থেকে তিনি এই কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তাদের এই বিশ্বাস যা ঐ বইগুলোতে ও তার কথার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তারপরও তারা মুসলিম রয়েছেন? দয়া করে কোরআন ও হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা করবেন।
(২) যদি তিনি আর মুসলিম না থাকেন, তবে কোরআন ও হাদীসের কোন দলীলের আলোকে তিনি ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে গেলেন?
>>উত্তরটি ছিল:
এই বইগুলোতে যা বর্ণিত হয়েছে, যা প্রশ্নকারী ব্যক্তির প্রশ্নের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা জঘন্য বিদায়াত এবং বানোয়াট কাহিনী যার ভিত্তি সঠিক ইসলামিক নীতির মধ্যে নেই, আল্লাহর কোরআন ও তাঁর রাসূলের (সা:) সুন্নাতে এর কোন ভিত্তি নেই। বিভ্রান্ত ও সত্য বিষয়ে অন্ধ - যারা (ইসলামের) সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তারা ব্যাতীত এটা কেউ বলতে বা বিশ্বাস করতে পারে না।
রাসূল সা: এর চুল এখনও বিদ্যমান রয়েছে এবং এটা রাখনেওয়ালা ব্যাক্তিকে সম্পদশালী বানিয়ে দিতে পারে, এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) স্বপ্নে এসে ঐ ব্যাক্তির কবরের নিকট দোআ করার কথা বলেছেন এমন দাবী করা তা সবই মিথ্যা ও জাল - যার কোন দলীল নেই। বুখারী ও মুসলিমের সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না।সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা:) কিভাবে লোকজনকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার জন্য কবরের পাশে যেতে নির্দেশ দিতে পারেন যেখানে তিনি (সা:) জীবিত অবস্থায় এমন কাজ করতে নিষেধ করেছেন এবং কঠোরতম ভাষায় এটা করা থেকে সতর্ক করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং মৃত্যুর পর তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য অনুসন্ধাণ করতে নিষেধ করেছেন? রাসূলুল্লাহ (সা:) এর ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু হয় নাই যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর (সা:) মাধ্যমে দীনকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেছেন এবং তার (আল্লাহর) অনুগ্রহ ও আশির্বাদ দ্বারা (দীন) সম্পূর্ণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহর বিধানে কোন কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের অবকাশ নেই। কবরের পাশে কোন দোআ করলে দোআ কবুল হবে এমন বিশ্বাস করা বিদাআত এর কোন ভিত্তি ইসলামে নেই, এবং এটা ব্যক্তিকে বড় ধরণের শির্কের দিকে ধাবিত করতে পারে যদি সে আল্লাহর পরিবর্তে কবরে শায়িত ব্যাক্তির নিকট ফরিয়াদ করে অথবা আল্লাহ তায়ালার নিকট চাওয়ার সাথে মৃত ব্যাক্তির নিকট কিছু চায় অথবা যদি সে বিশ্বাস করে যে কবরে শায়িত ব্যাক্তির উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে, কারণ একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালারই কারো উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রয়েছে।
তদ্রুপভাবে, “ফাকীর কখনও মরে না; বরং মৃত্যুর পর কবর থেকে সে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গমন করে, এবং মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে, যেমন সে জীবিত অবস্থায় পূরণ করত” - এমন বিশ্বাস আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস; এটি বিচ্যুত সূফীদের একটি আকিদাহ। শরীয়াতে এর কোন ভিত্তি নেই; বরং কোরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় পৃথিবীর সকল মানুষ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ
তুমি তো মরণশীল এবং উহারাও মরণশীলযুমার ৩০
وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ ۖ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ
আমি তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করি নাই; সুতরাং তোমার মৃত্যু হইলে উহারা কি চিরজীবী হইয়া থাকিবে?” সূরা আম্বিয়া ৩৪
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً ۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ, গ্রহণ করিবে; আমি তোমাদিগকে মন্দ ও ভাল দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়া থাকি এবং আমারই নিকট তোমরা প্রত্যাণীত হইবেআম্বিয়া ৩৫
সহীহ হাদীসসমূহে আরো বলা হয়েছে যে যখন কোন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমালনামা বন্ধ হয়ে যায় তিনটি বিষয় ছাড়া: উপাকারি বিদ্যা, সৎ সন্তান যে তার জন্য দোআ করে, আর সাদকা জারিয়াহ (মুসলিম, তিরমিযী)
মৃত ব্যাক্তি কবরে নিজেরই উপকার বা ক্ষতি সাধন করার ক্ষমতা নেই, এবং এটা অধিক ন্যায়সঙ্গত যে যারা এই অবস্থায় চলে গেছে তাদের অন্য কারোর জন্য কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই। শরীয়াতে এটার কোন অনুমোদন নেই যে, কোন ব্যাক্তি কারও নিকট এমন বিষয়ে সাহায্য চাইবে যে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারে না। মৃত ব্যক্তির নিকট এমন সাহায্য চাওয়া শিরকে আকবর বা বড় শির্ক। বড় কুফরি কাজ হওয়ার আলোকে যা নিষিদ্ধ করা করা হয়েছে এবং যা মানুষকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়, তা থেকে যে কেউ ভিন্ন কিছু বিশ্বাস করবে তাদের প্রতি আল্লাহ কঠোর হবেন কারণ ঐ বিষয়ে বর্ণিত কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে তার (ভয়াবহ) পরিণতি বিষয়ক প্রমাণিত দলীলকে সে পরিত্যাগ করেছে। তাকে অবশ্যই আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে, দৃঢ়সঙ্কল্প হতে হবে যে এরূপ শয়তানী কাজে আর ফিরে যাবে না, এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের শুরুর দিকের ন্যায়সঙ্গদের পথ (সালফে সালেহীনদের পথ) অনুসরণ করবে যাতে সে আল্লাহ সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ করতে পারে, এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে নিস্তার পেতে পারে।
[
ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দাঈমাহ (ভলিউম-২, ২/৯৭)]
>> ‘আল মাওসুয়াব আল-মুয়াসসারাব ফীল-আদীয়ান ওয়াল-মাদহাবহিব ওল-আহযাব আল মুয়াসিরাহবইয়ের প্রথম খণ্ডের ৩২২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে -
আরব দেশগুলোতে তাদের মজলিসে তারা অর্থাৎ, তাবলীগী জামায়াত রিয়াদুস সালেহীন পড়ার দিকে মনোযোগ দেয়, কিন্তু আরবের বাইরের দেশগুলোতে তারা হায়াতুস সাহাবাহ’, এবং তাবলীগী নিসাবপড়ার দিকে মনোসংযোগ করে; আর শেষের বইটি (তাবলীগী নিসাব) বানোয়াট কাহিনী ও যয়ীফ হাদীসের ভর্তি।
>>>সংক্ষেপে বলা যায়, বিদ্বানগণ সদা তাবলীগী নিসাবসম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক করে চলেছেন, যে বইটি ফাযায়েলে আমালনামেও পরিচিত। কোন মুসলিমের এটা পাঠ করার অনুমতি নেই; বরং তারা সহীহ হাদীসের কিতাব পড়ার দিকে মনোসংযোগ করবে, যেসব লেখক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অনুসরণ করেন তাদের বই পড়বে। যে সমস্ত বইয়ে বানোয়াট কাহিনী ও মিথ্যা রয়েছে, সেগুলোকে মুসলিমদের হৃদয় ও মনে কোনভাবেই স্থান দেয়া উচিত নয়।

এবং আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন